সোহেল খান দূর্জয় নেত্রকোনা :
টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে নেত্রকোণা সদর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কালিয়ারা-গাবরাগাতী ইউনিয়নে। চলতি বছরের জুন-জুলাইয়ের বন্যায়ও ক্ষতির মুখে পড়েছিল ইউনিয়নটি। সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ফের বন্যার কবলে পড়েছে ইউনিয়নবাসী। গত রোববার রাত থেকে বন্যার পানি ঢুকতে শুরু করে এই ইউনিয়নে। সোমবার সকালে ইউনিয়নটির অন্তত ২০টি গ্রামে পানি ঢুকেছে। এরপর থেকে মঙ্গলবার, বুধবার ও বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পানিবন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন গ্রামের পর গ্রামের বাসিন্দারা।ইউনিয়নের পাটলি গ্রামটিকে দূর থেকে দেখলে মনে হবে, পানিতে ভাসছে। কোথাও বুক সমান, কোথাও কোমর সমান পানি। গ্রামের প্রতিটি ঘরে বন্যার পানি ঢুকেছে। চারদিকে শুধু পানি আর পানি। গ্রামটির ভিতর দিয়ে যাওয়া পাকা রাস্তা ছেড়ে মসজিদের কাছে আমেনা আক্তারদের বসতবাড়ি। সোমবার রোদের দেখা মিলায় পানি কিছুটা কমেছিল। কিন্তু মঙ্গলবার সকালে মুষলধারে বৃষ্টি হওয়ায় আবার পানি বেড়েছে।
বৃষ্টির মধ্যে বানের পানি ভেঙে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের ভিতর চৌকির ওপর বসে আছেন আমেনা আক্তার। ঘরের ভিতরে হাঁটু সমান পানি। সেখানে বসেই পরিবার নিয়ে বন্যায় দুর্ভোগের মধ্যে থাকার কথা জানান তিনি। মধ্যবয়সী এই নারী বলছিলেন, “কেমনে বাঁচবাম, কিছুই বুঝতাছি না। কোমর হমান পানির মধ্যে কেমনে কী করাম। ঘরের মধ্যে পানি তই তই করতাছে। পোলাপান লইয়া বিপদে পড়ছি বেশি।“হেরারে কী খাওয়াইয়াম। ঘরের মধ্যে থাহনেরই বাও নাই, রান্না কেমনে করাম। টয়লেটে যাওনের বাউ নাই। কইনছেন দেহি এইবায় কি আর বাঁচন যায়?”প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি বা কোনো সংগঠন-সংস্থার কেউই কোনো খোঁজ না নেওয়ার আক্ষেপও করেন তিনি।
আমেনা আক্তারের মত পাটলি গ্রামের অনেকরই একই অবস্থা। পাশের বাড়ির আরজ আলীও একই রকম বিপদে থাকার কথা জানালেন। অতি ভারি বৃষ্টিপাত আর উজানের ঢলে সদর, দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, পূর্বধলা, বারহাট্টায় প্রায় এক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। মানুষের রান্না করা খাবারের পাশাপাশি গো-খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। গ্রামীণ সড়ক ডুবে গেছে। এরই মধ্যে দুর্গাপুরে ঢলের পানিতে তলিয়ে একজন মারা গেছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নেত্রকোণা জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী সারোয়ার জাহান বলেন, মঙ্গলবার বিকাল ৩টার হিসাব অনুযায়ী, সোমেশ্বরীর পানি কিছুটা বেড়েছে। এখনও পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। পাহাড়ি এই নদীর পানি দুর্গাপুর পয়েন্টে বিপৎসীমার দুই দশমিক ১৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে বইছে। উব্ধাখালী নদীর পানি ধীর গতিতে কমছে। কলমাকান্দা পয়েন্টে এই নদীর পানি বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ২৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে বইছে।আরেক প্রধান নদ কংশের পানি জারিয়া পয়েন্টে কমতে শুরু করেছে। সেখানে বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ৩৯ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে বইছে।
তবে হাওরের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা ধনু নদের পানি খালিয়াজুরী পয়েন্টে বাড়ছে। সেখানে বিপৎসীমার ১ দশমিক ৬৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে বইছে। এদিকে বন্যায় রোপা আমন ফসল ও শীতকালীন শাকসবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ভেসে গেছে অনেক মাছের খামার। কলমাকান্দা উপজেলার পাগলা এলাকার এনামুল হক বলেন, “তিন একর আমন লাগাইছিলাম। সবডাই তলায়া গেছে। কিছুই নাই।”সদরের পাটলি গ্রামের মাছ চাষি রুকন উদ্দিন বলেন, “গতকাল আমার চাষ করা পুকুর বন্যার পানিতে তলায় সব মাছ ভাইস্যা গেছে।”
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. নুরুজ্জামান বলেন, জেলায় ১৭ হাজার ৫৩৫ হেক্টর জমির আমন এবং ১৬৭ হেক্টর জমির শাক-সবজি তলিয়ে গেছে। বন্যা কবলিত অনেক দুর্গম এলাকার বানভাসি মানুষেরা ত্রাণ পাচ্ছেন না বলেও অভিযোগ করছেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানিয়া তাবাসসুম বলেন, “একই সঙ্গে চারটি ইউনিয়নসহ আরো কিছু নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। আমরা প্রত্যেকটা বাড়ি বাড়ি যাওয়ার চেষ্টা করছি। দুই-তিন ধরে আমাদের ত্রাণ কাজ চলছে।“কিছু হয়তো অভিযোগ থাকতে পারে। আমরা সেই অভিযোগ প্রত্যেকটি আমলে নিচ্ছি। আমরা চেষ্টা করছি। আমাদের স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে সহায়তায় দুর্যোগ মোকাবিলার চেষ্টা করছি।”
এদিকে দুর্গাপুর উপজেলার প্লাবিত পাঁচটি ইউনিয়নের ৪০টি গ্রাম থেকে ধীর গতিতে পানি নামতে শুরু করেছে। দুর্গাপুরের ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “পানি উঠে যাওয়ার কারণে উপজেলার ৭২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এখন অবশ্য পূজার ছুটি শুরু হয়ে গেছে। “উপজেলার ১০ হাজার হেক্টর ফসলি জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। শতাধিক মৎস্য চাষির পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। বন্যাদুর্গত এলাকায় বরাদ্দের ২০ টন চাল ও শুকনো খাবার ত্রাণ সহায়তা বিতরণ করা হচ্ছে।”নেত্রকোণা জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস বলেন, “নতুন করে বারহাট্টা উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় এখন পর্যন্ত পাঁচটি উপজেলা বন্যা কবলিত হয়েছে। ১০টি আশ্রয়কেন্দ্রে বানভাসি মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। জেলায় ৮৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থার মধ্যে রয়েছেন। তিনি বলেন, এ নাগাদ ৭০ মেট্রিক টন জিআর চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দুই হাজার শুকনো খাবারের প্যাকেট ও নগদ সাড়ে তিন লাখ টাকা উপজেলাগুলোতে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া উপজেলা পর্যায়ে আলাদা ত্রাণ রয়েছে। ত্রাণের কোনো ঘাটতি নেই।